খায়রুল আলম – বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার পথে অগ্রগামী ভূমিকায় ‘ফ্লিট বাংলাদেশ’
না, আমরা কোনো রণতরী বা নৌবহরের কথা বলছি না। বরং ফ্রিল্যান্সিং দুনিয়ায় কিভাবে বাংলাদেশ আজকে দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ সোর্স ‘ফ্লিট বাংলাদেশ’কে জানলে আপনি এর প্রমাণ পাবেন। পাশাপাশি খায়রুল আলম নামের এই আলোচিত উদ্যোক্তা কিভাবে দেশের ফ্রিল্যান্সিং আঙিনায় একজন আইকন হয়ে উঠলেন সে কৌতূহলও মিটবে আপনার। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গার্মেন্টস সেক্টরের পাশাপাশি আজ দুর্বার গতিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রেমিট্যান্স আসতে শুরু করেছে আউটসোর্সিং থেকে। এর অন্যতম কারণ আমরা খায়রুল আলমের মতো উদোক্তাদের পাচ্ছি আমাদের মাথার উপর ছায়ার মতোন করে। আপনার সামনে তার মতো একজনকে উপস্থাপন করতে পারা আমাদের জন্যও আনন্দের। তার দুর্দান্ত প্রচেষ্টায় আজকের ফ্লিট বাংলাদেশ একটা নতুন আশার নাম। এটা ইতোমধ্যেই দেশের ফ্রিল্যান্সিং পাড়ায় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে হাজারো হাই-প্রোফাইল ক্লায়েন্ট আছেন যারা ব্যক্তির চেয়ে এজেন্সিকে প্রাধান্য দেন। কারণ এজেন্সিকে ভারার্পণ করলে যেকোনো কাজ অনেক তাড়াতাড়ি উঠে আসে এবং সেক্ষেত্রে তাদের ব্যয় করতে কোনো কার্পণ্য নেই। তাই একজন প্রজ্ঞাবান, অভিজ্ঞ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করতে দেরি করেননি খায়রুল। সেটা এই ২০১৮ সালের কথা। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং পরিচালনার দিক থেকে এটা দেশের আউটসোর্সিংয়ে এক নতুন ভোর।
জার্নিটা যেভাবে শুরু
মূলত পড়াশোনার খারচ চালানো যাবে এ কথা শুনেই ভার্সিটি লাইফে ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে পা বাড়ান তিনি। খুব দ্রুতই বাবাকে হারিয়ে ফেলেন পার্থিব জীবন থেকে। মাথায় ছিলো পাহাড় সমান চাপ। ফলে বিবিএ শেষ করতে না করতেই যোগ দিলেন পিএইচপি গ্রুপে। পোস্টিং হলো চিটাগং এ। কিন্তু যে নেশা আর সম্ভাবনার সলুক তিনি পেয়েছিলেন ফ্রিল্যান্সিংয়ে সেটা ভুলতে পারেননি একদিনের জন্যও! এ নিয়ে সীমাহীন ঝোঁক ছিলো তখনও অটুট। তাই নিজের শরীরের প্রতি জুলুম হবে জেনেও অদ্ভুত কাণ্ড করতে লাগলেন তিনি। রুটিন করে দিনের বেলা অফিস আর মাঝরাত অব্দি ফ্রিল্যান্সিং। তিনি বলছিলেন,
“নিটোল মটরসে জয়েন করে আমাকে যথারীতি ৯টা থেকে ৬টা অফিস করতে হতো। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি ঝোঁক আমার একবিন্দু কমেনি। অফিস থেকে ফিরেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়তাম আর কাজ করতাম রাত ২-৩টা অব্দি। আপনি শুনলে হয়তো হাসবেন, এই ঘুমটা ঘুমিয়ে নিতাম অফিস যাওয়া-ফেরার পথে!”
এই সেই ঝোঁক যার বশে নিটোল মটরসের জবটা শেষমেষ ছেড়েই দিলেন তিনি। ফ্রিল্যান্সিং পেশায় ব্যতিক্রমী কিছু করবেন এই ছিলো স্বপ্ন। বঙ্গোপসাগরের বদ্বীপে আউটসোর্সিংয়ে একদিন রাজত্ব করবেন এমন প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করলো তার ফ্লিট বাংলাদেশ।
আর আপনি একমত না হয়ে পারবেন না যে বড় স্বপ্ন কেউ স্রেফ টাকার জন্য দেখে না, দেখে কিছু অবদান রাখবার জন্য।
ইচ্ছাশক্তির বলেই ব্যতিক্রম!
প্রাথমিকভাবে মাত্র ১০ জন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন খায়রুল। এখন এর সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। স্থায়ী কর্মীর পাশাপাশি এতে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন অনেকেই। সত্যিই ব্যতিক্রমী কিছু করে দেখিয়েছেন এই উদ্যোক্তা। পেশা হিসেবে আউটসোর্সিং বা রিমোট জব এদেশে এখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। খায়রুল আলমের রাজশাহীর মতোই দেশের হাজারো শিক্ষিত তরুণ বিলকুল বেকার। তাই তার প্রবল ইচ্ছা ছিলো এদেরকে কাজে লাগিয়ে দৃষ্টান্তমূলক কিছু করা। এই শক্তমত্ত ইচ্ছাশক্তিটাই ফ্লিট বাংলাদেশকে আজকের উচ্চতায় নিয়ে এসেছে। আজ বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান আমাজন, ওয়ালমার্ট এবং ই-বে ছাড়াও প্রায় শ’তিনেক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকসেবা দিয়ে থাকে ফ্লিট বিডি। ফ্লিটের দেয়া সেবাগুলোর ভেতর উল্লেখযোগ্য হলো আমাজন ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট, ফুলফিলমেন্ট বাই আমাজন, আমাজন প্রাইভেট লেভেল প্রোডাক্ট, ওয়ালমার্ট স্টোর ম্যানেজমেন্ট এবং ই-বে স্টোর ম্যানেজমেন্ট।
এক নতুন আশার স্থল
ফুলটাইম জবটা ছাড়ার আগে থেকেই স্বপ্নের সিঁড়ি গড়া অব্যাহত ছিলো। তাছাড়া সব সফল উদ্যোক্তাই জানেন কি করে কর্মীদের দেখভাল করতে হয়। আসলে খায়রুল তার কর্মীদের জন্য যা করছেন তা এক কথায় দৃষ্টান্তমূলক। তিনি বলেন,
“আমি নিজের চেয়ে আমার কর্মীদের জন্য কিছু করাকে প্রাধান্য দেই। কারণ আমি জানি দিনশেষে এটা আমাকেই বেনিফিট দেবে। তার চেয়েও বড় কথা, কারো জন্য বিশেষ কিছু করতে পারাটা সত্যিই প্রশান্তির!”
স্বার্থপরতার মাঝেও সৌন্দর্য খুঁজে নিয়েছেন খায়রুল। চলুন অল্প কথায় জেনে নেই তিনি মূলত তার কর্মীদের জন্য কি করে থাকেন।
এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে তিনি তার কর্মীদের আত্মীয় জ্ঞান করেন। তিনি তাদের সার্বিক দিক দিয়ে সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করেন। তাদের জন্য রয়েছে ইন্সুরেন্স, প্রোফিডেন্ট ফান্ড, মেডিকেল বিল, ফরেন ট্যুর, টিম বোনাস, ইয়ারলি বোনাস, পারফরম্যান্স বোনাস এবং এখানেই শেষ নয়! ভালো পারফরম্যান্স দেখালে তিনি তাকে আইফোন, বাইক, ডোমেস্টিক ট্যুর, ফাইভ-স্টার হোটেলে অবসর যাপনের মতো অবকাশ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। আরেকটা চমৎকার ব্যাপার হলো, তিনি তার অনূর্ধ্ব ৩০ কর্মীদের পিতামাতার জন্য রেখেছেন হজ-ফান্ড! বাংলাদেশে কোনো প্রাইভেট জব কোম্পানি বিশেষত কোনো ফ্রিল্যান্সিং এজেন্সির কাছ থেকে এমন কিছু পাওয়া প্রায় অকল্পনীয়!
সবমিলিয়ে ফ্লিট বাংলাদেশ তার পুরো বাহিনীকে একটা ঘরোয়া পরিবেশ উপহার দিয়েছে। এমন বাতাবরণ পেলেই না লোকে ভাবে যে তারা সেই প্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের আউটসোর্সিং ইতিহাসে এগুলো আসলেই অনন্য সংযোজন।
হতাশা আর চ্যালেঞ্জকে জয়
খায়রুলের মতে, শুরুতে তাদের জন্য সবচে’ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যাপারটা। ভয়ানক লোডশেডিং লেগেই থাকতো প্রতিদিন। আরেকটা সমস্যা ছিলো দুর্বল ইন্টারনেট। তবে তিনি বর্তমান অবস্থা নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট। এখন আমাদের পর্যাপ্ত পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে, রয়েছে ফোর-জি ইন্টারনেট স্পীড। এছাড়া খায়রুলের শুরুর দিকের হতাশা আর তার ফ্লিট বাংলাদেশ এতোটাই অবিচ্ছেদ্য যে সে দিকটা না বললেই নয়।
একসময় খায়রুল আলমকে একরকম যুদ্ধ করতে হয়েছে। আর দশটা বাংলাদেশী তরুণের মতো তিনিও বেশ আর্থিক সংকটে ভুগেছেন। কিন্তু জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো বরাবরই বিপ্লবী। তিনি নতুন কিছুকে ভালোবেসে চ্যালেঞ্জ আকারে নিতে জানেন। প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই অনলাইন জব খোঁজা আরম্ভ করেন খায়রুল। সেকেন্ড হ্যান্ড পিসি কেনার মতো টাকাও ছিলো না পকেটে। ক্লাস-এক্সাম শেষে ডিপার্টমেন্টের কম্পিউটার ল্যাবে বসে তিনি তার আউটসোর্সিং নলেজ ও স্কিলগুলো ঝালাই করে নিতেন। জানলে কষ্ট পাবেন, প্রতারক ক্লায়েন্টের খপ্পড়ে পড়ে জীবনের প্রথম ইনকামটাও তিনি হারিয়েছিলেন তিনি। সেটা সেই ফ্রিল্যান্সার ডটকমের অভিজ্ঞতা। তবে তিনি সেই হতাশাকে নিজের বিরুদ্ধে জয়ী হতে দেননি। খুব শীগ্রি তিনি আপওয়ার্কে ঢুকে পড়েন এবং একটা ডাটাবেইজের জবে ১৪ হাজার টাকা উপার্জন করেন। এর পরের প্রোজেক্টেই লুফে নেনে ৩০ হাজার টাকা। ব্যস, তখন থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
একজন অদম্য ফ্রিল্যান্সারের মাঝেই বড় উদ্যোক্তা থাকে। শুধুই ফ্রিল্যান্সার বা শুধুই উদ্যোক্তা, আপনি খায়রুলকে যেভাবেই দেখেন না কেন তাকে অনুকরণীয় বই অন্য কিছু মনে হবে না।
বড় কিছুর জন্য চাই বড় স্বপ্ন
এখনও রাজশাহীর বুকে অনেক শিক্ষিত তরুণ বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। খায়রুলের স্বপ্ন, তিনি তাদেরকে এই দশা থেকে মুক্ত করবেন। তিনি বলেন,
“দেখতে পাই মেধাবী তরুণদের একটা বিশাল অংশকে এখনও কাজে লাগানো যায়নি। ফ্রিল্যান্সিং দক্ষতায় তাদেরকে মানবসম্পদে পরিণত করা জাস্ট সদিচ্ছার ব্যাপার। আমি ওটাই করতে চাই।“
এছাড়া মানসম্পন্ন জীবনযাপনের জন্য যা যা করা লাগে তিনি তার স্টাফদের জন্য সেটাই করতে চান। যেনো সেটা আখেরে দেশেরই কাজে লাগে। দেশের জন্য এভাবেই তিনি অবদান রাখতে চান। রাজশাহী ভার্সিটির বহু তরুণ তার এজেন্সির হয়ে কাজ করেন। তাদের অনেকেই আবার রাজশাহী শহরের। নিজ শহরে পরিবারের পাশে থেকে কাজের সুযোগ পেয়ে তারাও বেশ খুশি।
যে অর্জন পুরস্কারের সমান
ফ্লিট বাংলাদেশ আজ পৌছেছে অন্য উচ্চতায়। কাজে সন্তুষ্ট হয়ে কিছু আমেরিকান ক্লায়েন্ট এসে তাদের রাজশাহীর অফিস পর্যন্ত ঘুরে গেছেন! এটা নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটা অর্জন! তাদের এহেন সব অর্জনে মুগ্ধ হয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম ফ্লিট বাংলাদেশকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। তারা দুজনেই ফ্লিটকে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে জায়গা দেয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন যেখানে প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মী একসাথে এক ছাদের নিচে কাজ করতে পারবেন!
তবে ফ্লিট এবং তার সিইও জনাব খায়রুল আলম এই অর্জনকে যথেষ্ট মনে করছেন না। তারা যেতে চান আরও বহুদূর। যতটা গেলে ফ্লিট বাংলাদেশকে একটা তারার মতো লাগে! source
No comments